
ট্রাইজিমিনাল নিউরালজিয়া মুখের এক প্রকার স্নায়ু ব্যাধি বা রোগ। এটি “Tic douloureaux” নামেও পরিচিত, যা মানবদেহের একটি অন্যতম বেদনাদায়ক অসুখ বলে মনে করা হয়। ট্রাইজিমিনাল নিউরালজিয়া মাথার সর্বাধিক প্রসারিত স্নায়ুগুলির মধ্যে একটি ৫ম ক্রেনিয়াল নার্ভ, ট্রাইজিমিনাল নার্ভকে প্রভাবিত করে।
এক সমীক্ষায় দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ১ লক্ষ লোকের মধ্যে প্রায় ১২ জন এ রোগে আক্রান্ত হয় এবং বর্তমানে প্রায় ১৪০,০০০ জন মানুষ এই রোগে ভুগছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে এ রোগ সারা বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষকে প্রভাবিত করবে। এ রোগে আক্রান্তের হার পুরুষের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে দ্বিগুণ এবং এটি সাধারণত ৫০ বছর বয়সের পরে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
ট্রাইজিমিনাল নিউরালজিয়া কী?

ট্রাইজিমিনাল নিউরালজিয়া মুখের একটি স্নায়ু ব্যাধি যা অতিমাত্রায় বেদনাদায়ক, দীর্ঘস্থায়ী ও ট্রাইজেমিনাল নার্ভ এর সাথে জড়িত। এক্ষেত্রে হঠাৎ করে মুখের বিশেষ করে নীচের মুখ, চোয়াল এবং নাক, কান, চোখ বা ঠোঁটের চারপাশে তীব্র ব্যথার সৃষ্টি করে। যেকোন ব্যথা nociceptive এবং Non-nociceptive হতে পারে। ট্রাইজিমিনাল নিউরালজিয়া এক প্রকার Non-nociceptive ব্যথা। সাধারণত স্নায়ুর ক্ষতি বা জ্বালা থেকে Non-nociceptive ব্যথার সৃষ্টি হয়। আক্রান্ত ব্যক্তি এই ব্যথাকে স্বল্পস্থায়ী তবে তীব্র জ্বলন্ত বা ছুরিকাঘাতের ব্যথা হিসাবে বর্ণনা করেন। সাধারণত মুখের একপাশে কয়েক মিনিটের জন্য ব্যথা অনুভূতি হতে পারে। য
দিও এ রোগের ব্যথার সময় সংক্ষিপ্ত কিন্তু ট্রাইজিমিনাল নিউরালজিয়া রোগটি একটি দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা যা সময়ের সাথে আরও খারাপ দিকে ধাবিত হতে পারে।
এই রোগের কারণসমূহঃ
- ট্রাইজিমিনাল নিউরালজিয়ার প্রধান কারণ হল কোন রক্তনালী ট্রাইজিমিনাল নার্ভের রুট বা মূলের উপর চাপ দেওয়া। এর ফলে স্নায়ু সংক্রমণ হয় যা ব্যথার সংকেতগুলিকে আন্দলিত করে তোলে। রোগী একে সূচ বা ছুরিকাঘাতের ব্যথার সাথে তুলনা করেন।
- কোন টিউমার বা অন্য কোন রোগ থেকেও এই রোগ হতে পারে।
- এছাড়াও স্নায়ুর যেকোন প্রকার ক্ষতি, আঘাত, দাতের অস্ত্রোপচার বা যেকোন সংক্রমণের ফলে এই রোগ হতে পারে।
- পারিবারিক বা জেনেটিক কারণেও রোগটি হতে পারে।
- কখনও কখনও এ রোগের কারণ অজানা থাকে।
ব্যথার ক্ষেত্র:
রোগীর ব্যথার ক্ষেত্রটি মূলত ট্রাইজিমিনাল নার্ভের তিনটি শাখার উপর ভিত্তি করে বলা হয় যেমন:
- অপথ্যালমিক: সাধারণত কপাল, নাক এবং চোখকে প্রভাবিত করে।
- ম্যাক্সিলারি: সাধারণত নিচের চোখের পাতা, নাকের পাশে, গাল, ঠোঁট এবং উপরের দাঁতকে প্রভাবিত করে।
- ম্যান্ডিবুলার: চোয়াল, নিচের দাঁত, এবং নিম্ন ঠোঁটকে প্রভাবিত করে।
ট্রাইজিমিনাল নিউরালজিয়া এর যেকোন একটি অথবা কখনও কখনও একসাথে একাধিক শাখাকেও প্রভাবিত করতে পারে।
লক্ষণসমূহঃ
TN এর রোগীর প্রধান অভিযোগ হচ্ছে মুখে ব্যথা। ব্যথা সাধারণত তীব্রতর হয় বা মাংশপেশী সংকোচনের মাধ্যমে হতে পারে যা রোগীর ভাষায় বৈদ্যুতিক শকের বা ধারালো সূচের আঘাতের মতো অনুভব করে। ব্যথা সাধারণত মুখের যেকোন একপাশে ঘটে। কোন প্রকার শব্দ বা মুখ স্পর্শ দ্বারাও এর ব্যথা অনুভুতি হতে পারে। রোগের প্রথমাবস্থায় ব্যথা কয়েক সেকেন্ড বা কয়েক মিনিট স্থায়ী হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে তা দিন, সপ্তাহ বা কয়েক মাস ধরে ব্যথার অনুভুতি থাকতে পারে।
ব্যথা দৈনন্দিন নিয়মিত কাজের মাধ্যমেও তীব্র বা ট্রিগার হতে পারে, যেমনঃ
- ১। দাঁত মাজা
- ২। সেভিং
- ৩। মৃদু বা অট্ট হাসি
- ৪। মেকআপ করা
- ৫। মুখ স্পর্শ
- ৬। অতি ঠান্ডা বা গরম খাবার খাওয়া অথবা কিছু পান করা।
- ৭। কথা বলা।
- ৮। মুখে এসি বা ফ্যানের বাতাস লাগা।
রোগ নির্ণয়ঃ
কোন ব্যক্তির লক্ষণসমূহ যদি ট্রাইজিমিনাল নিউরালজিয়ার দিকে নির্দেশ করে তবে প্রথমে আক্রান্ত অঞ্চলগুলো নির্ধারণের জন্য একজন চিকিৎসক রোগীর মুখ ও লক্ষণসমূহ পরীক্ষা করবেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগটি নির্ণয় হয়। এছাড়াও কিছু ইমেজিং টেকনিক যেমন এমআরআই স্ক্যান এর মাধ্যমে অন্য রোগ যেমন দাঁত ক্ষয়, টিউমার বা সাইনোসাইটিসের মতো অনুরূপ লক্ষণসমূহের রোগকে দূর করতে সহায়তা করে। অনেক সময় এমআরআই এর মাধ্যমে এই রোগের সঠিক কারণটি খুজে পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। সেক্ষেত্রে আরোও কিছু অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে।
অ্যাটিপিকাল ট্রাইজিমিনাল নিউরালজিয়াঃ
অ্যাটিপিকাল ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়া সাধারণত ট্রাইজিমিনাল নিউরালজিয়ায় একটি প্রকরণ। এসব রোগীর অভিযোগে তীব্র বা ছুরিকাঘাতের ব্যথার লক্ষণের পরিবর্তে মুখের কোন স্থানে জ্বলন, হালকা ব্যথা বা বাধা অনুভূতি হিসাবে বর্ণনা করতে পারে।
এটিও মুখের একপাশে হতে পারে, প্রায়শই ট্রাইজিমিনাল নার্ভের অঞ্চলে থাকে এবং উপরের ঘাড়ে বা মাথার ত্বকের পিছনে প্রসারিত হতে পারে। লক্ষণের মধ্যে হালকা ব্যথা থেকে ক্রাশিং বা জ্বলন সংবেদন থেকে তীব্রতায় ওঠানামা করতে পারে। ট্রাইজিমিনাল নিউরালজিয়ার অ্যাটিপিক্যাল উপস্থাপনা অনেকক্ষত্রেই নির্ণয় করা কঠিন।
চিকিৎসাঃ
ট্রাইজিমিনাল নিউরালজিয়ার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা রয়েছে। প্রধান চিকিৎসার মধ্যে মেডিকেশন(এন্টিকনভালসেন্ট, ব্যথানাশক) এবং অস্ত্রোপচার রয়েছে। এ রোগের চিকিৎসার জন্য ওষুধ আজকাল সবখানেই পাওয়া যায়। তবে রোগের মাত্রা ও তীব্রতার সাথে মেডিকেল ট্রিটমেন্ট অনেক ক্ষেত্রে কম কার্যকর হতে পারে। তাছাড়াও অবাঞ্ছিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে। সেক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে অস্ত্রোপচারই সেরা । তবে যেই চিকিৎসা পদ্ধতিই অবলম্বন করা হোক না কেন কারো কারো ক্ষেত্রে এই রোগটি পুনরায় ফিরে আসার সম্ভাবনাও রয়েছে।
সার্জারিঃ
অনেকের মাঝেই অস্ত্রোপচার নিয়ে ভীতি কাজ করে। এক্ষেত্রে ভীত হওয়ার কোন কারণ নেই। আজকাল নানাবিধ সহজ ও তুলনামূলক কম ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এই রোগের ভালো চিকিৎসা সম্ভব। সার্জারির লক্ষ্য ট্রাইজিমিনাল নার্ভের বিরুদ্ধে চাপ দেওয়া থেকে শিরা বা ধমনী বন্ধ করা অথবা অনিয়ন্ত্রিত ব্যথার সংকেত বন্ধ করা। কোন কারণে স্নায়ুর ক্ষতি সাধিত হলে অস্থায়ী বা স্থায়ী মুখের অসাড়তা হতে পারে।
প্রতিরোধঃ
নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো এই রোগ আক্রমণ রোধ করতে সহায়তা করতে পারে:
- নরম খাবার খাওয়া।
- খুব ঠান্ডা বা গরম এমন খাবার এড়ানো।
- হালকা পানি দিয়ে মুখ ধোয়া।
- মুখ ধোয়ার জন্য তুলা বা প্যাড ব্যবহার করা।
- আলতভাবে দাঁত ব্রাশ করা, খাওয়ার পরে হালকা গরম পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলা।
- যতদূর সম্ভব এ রোগের জানা ট্রিগারগুলি বা যেসকল কাজ করলে ব্যথা তীব্র হয় তা এড়িয়ে চলা।
ট্রাইজিমিনাল নিউরালজিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির করণীয়ঃ
এ রোগের যথাযথ চিকিৎসা অপরিহার্য। ভীত না হয়ে একজন মেডিসিন অথবা নিউরোমেডিসিন স্পেশালিস্ট ডাক্তারের পরামর্শে রোগের মাত্রা ও তীব্রতার উপর ভিত্তি করে সবচেয়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। অনেকক্ষেত্রে আকুপাংচার, পুষ্টি থেরাপি এবং ধ্যানের মতো পরিপূরক কৌশল কিছু সহায়ক হতে পারে। তবে যেকোন বিকল্প চিকিৎসা শুরু করার আগে আপনার ডাক্তারের পরামর্শ মতন চলাই শ্রেয়। নিজ উদ্যোগে কিছু না করাই উত্তম। আতংকিত না হয়ে সময়মত সঠিক চিকিৎসায় রোগ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিজেকে ভালো রাখা সম্ভব।
More Stories
স্বাস্থ্য কথনঃ এ্যাজমা বা হাঁপানি কি এবং করণীয় | ডা.রায়হানুল হক
কতটুকু ফ্যাট খেতে হবে?
কিছু মানুষ কখনোই করোনায় আক্রান্ত হবেন না…কারা তারা ?